বড় ধরনের খাদ্য সংকটে ইসরায়েল: যুদ্ধ ও অবরোধের ছায়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় সংকট
ইসরায়েল এখন অভ্যন্তরীণভাবে বড় ধরনের খাদ্য সংকটে পড়েছে—এমনটাই জানাচ্ছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ সংস্থা ও মিডিয়া রিপোর্ট। চলমান গাজা যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অবরোধ, এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশটি এখন খাদ্য আমদানি ও বণ্টনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যার সম্মুখীন।

যুদ্ধ ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন
২০২৩ সালের শেষ দিক থেকে গাজা উপত্যকায় হামাস ও অন্যান্য ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীর সঙ্গে ইসরায়েলের চলমান সামরিক সংঘাত ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বিশ্বের নানা প্রান্তে এই যুদ্ধের নিন্দা জানানো হলেও, ইসরায়েলের অবস্থান কঠোর থেকেই গেছে। এর ফলে অনেক মুসলিম ও উন্নয়নশীল দেশ—যেমন মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, আলজেরিয়া, এমনকি কিছু ইউরোপীয় সংস্থা—ইসরায়েলের সঙ্গে কৃষিপণ্য রপ্তানি বন্ধ করেছে।
বিশেষ করে গম, চাল, ফলমূল ও সবজি আমদানির ক্ষেত্রে সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। ইসরায়েল তার অধিকাংশ খাদ্য আমদানি করে বাইরের দেশ থেকে, যেহেতু দেশটির আভ্যন্তরীণ কৃষি উৎপাদন বেশ সীমিত এবং মরুপ্রধান এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। সেজন্য এই রপ্তানি বন্ধ দেশটির খাদ্য নিরাপত্তায় মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে।
খাদ্য গুদাম ও পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত
সম্প্রতি একাধিক ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে সুপারমার্কেটগুলোতে পণ্যের তাক প্রায় খালি, মানুষ দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করছে অল্প কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর জন্য। দেশটির দক্ষিণাঞ্চল এবং সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে এই সংকট আরও প্রকট, যেখানে যুদ্ধের কারণে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ইসরায়েলের খাদ্য সংরক্ষণ কেন্দ্র ও গুদামঘরের ওপর সাম্প্রতিক রকেট হামলা এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীর আক্রমণ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। অনেক খাদ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নিরাপত্তার অভাবে সেবা বন্ধ করে দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা প্রত্যাখ্যান
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আন্তর্জাতিক রেডক্রস ইতোমধ্যেই ইসরায়েলকে মানবিক সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে। তবে, দেশটির কট্টর ডানপন্থী সরকার এখনো পর্যন্ত সেই সহায়তা গ্রহণে প্রস্তুত নয়। সরকারের দাবি, তারা “নিজস্ব সক্ষমতায়” পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে।
এদিকে, সাধারণ জনগণের মধ্যে এই সংকটের ফলে ক্ষোভ দানা বাঁধছে। ইতোমধ্যে তেল আবিব ও জেরুজালেমসহ একাধিক শহরে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়েছে, যেখানে খাদ্যসংকট, মূল্যবৃদ্ধি, এবং যুদ্ধ নীতির সমালোচনা করা হচ্ছে।
শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে অপুষ্টি বাড়ছে
ইসরায়েলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র অনুযায়ী, বিগত ৬ মাসে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি সমস্যা ৩২% বেড়েছে। একইসঙ্গে বৃদ্ধ ও অসহায় জনগোষ্ঠীর মাঝে পুষ্টিহীনতা, দুর্বলতা, ও বিভিন্ন সংক্রামক রোগ বেড়েছে। বেশ কিছু এনজিও এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিতরণ কার্যক্রম চালালেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
কৃষিখাতে ভরসা কম
ইসরায়েল যে স্বয়ংসম্পূর্ণ খাদ্য উৎপাদন করতে পারবে না, তা আগে থেকেই জানা। দেশটির বেশিরভাগ কৃষিজমি মরুপ্রধান ও পানির অভাবে জর্জরিত। কৃষিক্ষেত্রে হাই-টেক প্রযুক্তি থাকলেও সেটি কেবল চাহিদার ৩০-৪০% পূরণ করতে সক্ষম। বিদেশি রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় বর্তমান বাণিজ্যিক বিচ্ছিন্নতা তাদের অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।
মুসলিম দেশগুলোর বয়কটের প্রভাব
বিশ্বজুড়ে চলমান মুসলিম দেশগুলোর ইসরায়েলবিরোধী বয়কট আন্দোলনের কারণে ইসরায়েলি পণ্যের বাজার সংকুচিত হয়েছে এবং বিপরীতে ওইসব দেশ থেকেও খাদ্য আমদানি বন্ধ হয়েছে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ইরানসহ অনেক দেশ ইতোমধ্যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিবাদ জানিয়েছে। এরই ফলস্বরূপ ইসরায়েল ভোগ করছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক নিঃসঙ্গতা।
সমাধান কোথায়?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরায়েল যদি দ্রুত যুদ্ধ বন্ধ না করে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে না তোলে, তাহলে আগামী কয়েক মাসেই সেখানে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। জাতিসংঘ এবং আরব লিগ এই সংকটকে "মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাস" হিসেবে দেখছে।
ইসরায়েলের সাধারণ নাগরিকেরা এখন সরকারের কঠোর পররাষ্ট্রনীতির মূল্য দিচ্ছে খাদ্যসংকটের মাধ্যমে। এটি কেবল তাদের দৈনন্দিন জীবনকে বিপর্যস্ত করছে না, বরং তাদের ভবিষ্যৎকেও অন্ধকার করে তুলছে।
প্রথম সংবাদ ভবিষ্যতে এ ধরনের সংকটের প্রতিটি আপডেট আপনাদের জানাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের সাথেই থাকুন।